অর্ধেক সত্যের অর্ধেক ভ্রম(ণ) | সামি আল সাকিব


মাঝেমধ্যে অকারণ দুঃখ হয়। আমরা তখন অকারণে বেড়িয়ে পড়ি। হাঁটতে হাঁটতে চড়ে বসি বাসে। তারপর ধীরেসুস্থে বাস এগোয়, যেন তার অন্তিমযাত্রা। নগরীর জট ক্রমে সরে যায়, বড় রাস্তা সরু হতে থাকে, আমাদের মনে হয় যেন ফিরে যাচ্ছি আপন-আলয়।

অনেকক্ষণ বাদে অন্তিম গন্তব্য এলে নেমে পড়ি বাস থেকে, হেল্পার নামবার তাড়া দেয়। তারপর পকেট হাতড়াতে গিয়ে পড়ে থাকা সিগারেট, ম্যাচ আর লজেন্স বের করি, মুখে পুড়ে ঠোঁটে ছোঁয়াই অগ্নি-কাণ্ড, তাতে আগুন জ্বালিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করি। একসময় মজুদ ফুরিয়ে যায়, আগুন নিভে যায় অগ্নি-কাণ্ডে। ছুঁড়ে ফেলে জুতোয় পিষে ফেলি, আমরা হাঁটায় মনোযোগী হই। মনোযোগী হই রাজনীতি, গল্প-কবিতা, ধর্ম-বিজ্ঞান আর প্রেয়সীর সাথে অহেতুক আলাপে, তর্কে।

তারপর একসময় পথ ফুরিয়ে গেলে একটা গ্রাম, আদর্শ এক পল্লিগ্রামে নিজেদের খুঁজে পাই। আমরা বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়ি গ্রামে। এদেশ আমাদের, এই গ্রাম আমাদের না হোক, এই দেশের গ্রাম বলেই এটা আমাদেরও গ্রাম। নিজ গ্রামে অনুমতি নেবো কেন? নিই না।

এগোতে এগোতে গিয়ে দাড়াই সবচে’ প্রবীণ দোকানির দোকানে। নিঃসঙ্কোচে জানতে চাই, দাদু, ভাত খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করা যায়?

তিনি বলে দেন, আপনেরা এই অসময় রাইতের বেলা আইসলেন দাদুভাই, দিদিমণি! এহন কি ব্যবস্থা করি! তিনি আমাদের দাড় করিয়ে রাখেন। দ্রুত বন্ধ করে দেন খাঁ খাঁ মরুভূমির মতো করা দোকানখানা, পুরোনো টিভিতে পুরোনো দিনের ছায়াছবি। বলেন, আসেন আপনেরা,আইজকা আপনেরা আমার সাগাই। সাগাই মাইনষেক খালিপেট ফিরাই কেবে!

আমরা বৃদ্ধের পিছু নিই। মেঠোপথ হাঁটতে হাঁটতে ঝি ঝি পোকার ডাক ভেসে আসে কানে, পথের দু'ধারের ঝোপের আড়াল ছেড়ে হঠাৎই উড়তে উড়তে এগিয়ে চলে জোনাক-পোকা, দূর থেকে ভেসে আসে শেয়ালের ডাক, আকাশে উঁকি দেয় পূর্ণিমার চাঁদ, সেই আলোতে দিশাহারা আমাদের চোখে সেই বৃদ্ধ দোকানিকে মনে হয় আলোর মশাল, পথ দেখিয়ে নেয়া প্রদর্শক।

একসময় তার বাড়ি পৌছাই। মরিচা পড়ে ক্ষয়ে ওঠা টিনের দোচালা ঘর। যেন বৃদ্ধের আয়ুর মতোনই, একেবারে অন্তিমপ্রান্তে পৌছে যাওয়া। তিনি হাঁক ছেড়ে ডাকেন, কইগো গোলাপীর মাও! জলদি বাইরে আইসেন, সাগাইক আইনেছি সাথে করি। ইনাগোর হাত-পাও ধুইবার ব্যবস্থা করেন জলদি, কয়ডা পাকশাক শুরু করেন মাও-বেটি মিলে। সাগাইদারি করতে হবি না!

ভাঁজপড়া দেহের আড়ষ্টতা ভেঙে এক সাদা চামড়ার বৃদ্ধা বের হন। পান খাওয়া লাল ঠোঁট নাড়িয়ে শুনে নেন বিস্তারিত, জেনে নেন কুশলাদি। তার ঠিক পেছনে দরজার ওপাশটাতে কেউ লুকিয়ে আমাদের দেখছে, সম্ভবত কিছুটা অবাকও হচ্ছে সেইসাথে। সম্ভবত কোনো একজন নারী। সদ্য কৈশোর পেরোনো চিরায়ত বাংলার দস্যি মেয়ে।

আমরা কল-পাড়ের দিকে এগোই। একে একে জুতো আর অতিরিক্ত পরিধেয় খুলে চরণে মৃত্তিকার ছোঁয়া দিই। রাতের ঘাস জড়ানো মাটির ছোঁয়া আমাদের পরিশ্রান্তি কমিয়ে দেয়। একে একে মেঁটে স্বাদের পানি ছুঁইয়ে পরিষ্কার হয়ে নিই, মুঠোয় করে পানিতে ভিজিয়ে নিই গলা। কল-পাড়টা বাড়ির পেছন দিকের জঙলা মতোন জায়গায়, আলো কম। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসে। বৈদ্যুতিক বাল্বের মৃত আলো ছাপিয়ে যায় পূর্ণিমার চাঁদ। ওদিকটায় রান্নাঘর থেকে কাটাকুটি আর তেলে ভাজার শব্দ ভাসতে ভাসতে কানে আসে, কিছুটা রান্নার ঘ্রাণও আসে সাথে।

আমরা জলচৌকিতে গিয়ে বসি। বৃদ্ধও বসেন আমাদের সাথে। তার স্ত্রী আর গোলাপী নামের সদ্য কৈশোর পেরোনো সেই মেয়েটিও আসে। তাদের হাতে গামলা ভর্তি গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, তরকারি, ডিম ভাজা আর ভর্তা। গামলাগুলো রেখে যাবার ফাঁকে আমাদের দিকে অবাক হয়ে চোখ বুলিয়ে নেয় গোলাপী। আমাদের উপস্থিতি তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সম্ভবত কিংবা আমাদের মতো কারো দেখা প্রথম পেয়েছে বলেই কি-না। বৃদ্ধা ভেতরে চলে যান, সাথে গোলাপী। একফাঁকে সে এসে জগভর্তি কলের মেঁটে স্বাদের ঠাণ্ডা পানি আর কাঁসার ভারী মগ রেখে যায়।

বৃদ্ধ দোকানী আমাদের আপ্যায়নের দায়িত্ব তুলে নেন। তাকে থামিয়ে বসিয়ে নিই আমাদের সাথে। খাবারের সাথে চলতে থাকে গল্প। রাজার দেশের প্রজার গল্প। প্রজার সাথে রাজকুমারীর প্রেমের গল্প। খুব সাধারণ আয়োজনেও আমরা প্রচুর আগ্রহ নিয়ে খেতে থাকি। খেয়ে ফেলি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা বেশি। তারপর উঠে হাত-মুখ ধুয়ে আসতেই কাসার মগভর্তি চা আসে।

বাড়ির খানিকটা সামনেই পুকুর। চারপাশে বড় গাছপালা ভরা। একপাড়ে কিছুটা পরিষ্কার জায়গা, সামনে বাঁশের মাচাঙ। সেখানেই বসে অবসর কাটাবার ব্যবস্থা। রাতে আঁধারে ঢাকা থাকে অন্যান্য দিন, আজকের রাতটা অবশ্য আলাদা। আজ পূর্ণিমার রাত। চাঁদের আলোয় চারপাশটা বেশ পরিষ্কার, নেশাজড়ানো আলোয় পূর্ণ। পুকুর জুড়ে চাঁদের আলো পড়ছে আর মৃদু ঠাণ্ডা বাতাসের সাথে ঢেউ হয়ে যেন বসেছে চাঁদের হাট। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে। খুব কাছেরই কোনো গাছের আড়াল থেকে ডেকে চলেছে কোনো পাখি। খুব চেনা স্বর। সম্ভবত ডাহুক পাখি।

আমাদের হাতে চায়ের মগ। আমি সিগারেটে আগুন ছুঁইয়ে ধোঁয়া ওড়াতে থাকি। কুণ্ডলী জমে উঠে যায় আকাশে। কাঙ্ক্ষিতার হাতে সিগারেট দিয়ে আমি চা পান করি। ওর চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। একটা শেষ করে আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে সে। অর্ধেকটা খেয়ে আমাকে দেয়ার পর উল্টোদিকে পুকুরের দিকে মুখ করে বসেছে সে।

আজ জোছনা রাত। আমাদের সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সময়। জোছনা রাতটা বিশেষ পছন্দের দুজনেরই। আমাদের কেমন এক সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে চলে তার ঢেউয়ের সাথে, আলোর সাথে, জীবনের সাথে।

সাথে করে আনা গিটারে টুংটাং সুর বাজছে কাঙ্ক্ষিতার হাতে। এই সময়টা প্রচণ্ডরকম লোভনীয় মনে হয় আমার। যেন আমি উলুকের মতো শতবছর কেবল এই সময়েরই অপেক্ষায়। ওর কণ্ঠে গান আমার সবকিছু ভুলিয়ে দেয়।

একসময় ও গাইতে শুরু করে। ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনেরও মন্দিরে.. ’।

আমি মোহাবিষ্ট, মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি, ওর ঠোঁটের নড়চড়, চোখের গভীরতা, শব্দের আবেগ, মুখের ভাবলেশহীনতা..সব কিছু আমাকে নতুন এক জগতে নিয়ে যায়। আমি যেন নয়া জগতের বাসিন্দা। যেখানে আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। এভাবে মৃত্যু পেলে বোধহয় আমরা জীবনের প্রতি আগ্রহী হতাম..

না, সম্ভবত আমরা ছাড়াও আরও কেউ আছে আশপাশে। গোলাপী। আমার ধারণা সে তার চোখ এবং কানকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না, একজন বিদেশিনী-মতোন শেতাঙ্গ নারী কি স্বর্গীয় সুরে এতো গভীর মায়া নিয়ে বাংলা গান গাইছে। তারচেয়েও বড় কথা, তার সাথে যেই কৃষ্ণতর রূক্ষ পুরুষ, তার সাথে নারী’টির বিশেষ সম্পর্ক আছে। এমনও কি সম্ভব!
কিছু বিষয় বোধহয় সম্ভব। আবার সম্ভব না। এই যেমন আমাদের কথা, আমরা মূলত কোনোদিন এক হবো না, অথচ আমরা একত্রেই।

কাঙ্ক্ষিতা গেয়ে চলেছে। বৃদ্ধ এর মাঝে একবার এসে নতুন মগভর্তি আরো বেশ খানিকটা চা দিয়ে গেছেন। বৃদ্ধের সাথে গোলাপী ফিরে গেছে। চা খেতে খেতে গান ফুরাবার পর বেশ কিছুক্ষণ আমরা জলের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রস্নান করেছি। তারপর একে অপরের দিকে তাকিয়ে থেকেছি চুপচাপ। সম্ভবত চোখ পড়তে চেয়েছি। অথচ আমাদের চোখ যেন ব্ল্যাকহোল। একবার ঢুকে পড়লে আর গভীরতা ঠাউড়ে বেরোতে পারি না বলে দুজনেই নামিয়ে নিয়েছি চোখ। তারপর আবারো বিক্ষিপ্ত হয়ে খুঁজতে বসেছি একাত্মতা।

ফোনকলের শব্দে ঘোর ভেঙে যায়। কাঙ্ক্ষিতার ফোনে কল এসেছে। ওর ব্যক্তিগত গাড়িচালকের ফোন। সে আমাদের অনুসরণ করতে করতে চলে এসেছে এই গ্রামে। আমাদের ফিরবার তাড়া দেয় সে। আগামীকাল কাঙ্ক্ষিতার ফিরে যাবার দিন। আমরা আর বিক্ষিপ্ত হতে চেয়েও পারি না।

অসামাজিক হবার পরেও সামাজিক প্রাণী বলেই কি-না ধীরে ধীরে উঠে হাঁটতে শুরু করি। বৃদ্ধের কাছ থেকে বিদায় নিই। তিনি আমাদের গাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে আসেন, সাথে তার স্ত্রী আর গোলাপী। গাড়িতে উঠবার আগে বিদায় চেয়ে নিই। কাঙ্ক্ষিতা একটা খামে কিছু টাকা পুরে সন্তর্পণে দিয়ে দেয় বৃদ্ধার কাছে। আমরা বিদায় নিই। বৃদ্ধ আমাদের হাসিমুখে বিদায় দেন, কথা নেন আবারো ফিরে আসবার।

গোলাপীর কাছে গিয়ে নিচুস্বরে বলে আসি, সব পাওয়া পাওয়া নয়, জীবন যেমন দেখায়, বাস্তবতা তেমনটা না’ও হতে পারে। সে কোনো প্রত্যুত্তর দেয় না, নিরবে প্রস্থান দেখবার প্রহর গোণে সম্ভবত।

আমরা গাড়িতে উঠে বসি। গাড়ি চলতে শুরু করে। পেছন থেকে বৃদ্ধ হাত নাড়ছেন। আমরা চুপচাপ এগোই। যেমন চুপচাপ এসেছিলাম। যেন আমরা মূকমানব, হৃদয়হীন, ভাবলেশহীন, দায়সারা। আমাদের কোনো উষ্ণতা নেই। শীতে জমে গেছি, আমরা তীব্র শীতার্ত যেন। আমাদের জীবন, সম্পর্কের মোড়, অধিকারহীনতা, অসহায়তার আক্ষেপ নিরবে ডুকরে ওঠে। অথচ বলার মতো ভাষা নেই আমাদের।

আমরা ছুটে চলি গন্তব্যে। সময়, জীবন, দায় লেখা প্রহরী আর সমাজ প্রতিনিয়ত তাড়া দিতে থাকে আমাদের। আদতে আমাদের কোনো তাড়া নেই। আমাদের গন্তব্য মূলত গন্তব্যহীনতার। আমরা ছুটে চলি জীবনের পানে, আমাদের যাযাবর জীবনে..

গাড়িতে হালকা স্বরে গান বেজে চলেছে —
“ আমার লতার একটি মুকুল, ভুলিয়া তুলিয়া রেখো- তোমার অলকবন্ধনে;
আমার স্মরণ শুভ-সিন্দুরে, একটি বিন্দু এঁকো- তোমার ললাটচন্দনে ”

গাড়ি এগোয়, আমরা চুপচাপ দেখে যাই গতি, জীবনের গতি। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়, পথঘাট ভিজে একাকার। সম্ভবত আরও কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। সম্ভবত আমাদের হৃদয়ে। পানিহীন বৃষ্টি। আমাদের শুকিয়ে যাওয়া ভ্রমের মতো, পঁচে গলিয়ে দেয়া আমাদের নীলপদ্ম-জন্মভূমির খরার মতো...

                                    ---
                                              
~ ‘ অর্ধেক সত্যের অর্ধেক ভ্রম(ণ)’
~   সামি আল সাকিব
~   ০৬-১২-২০২০


 

Comments

Popular posts from this blog

বুক রিভিউ: যাপিত জীবন - সেলিনা হোসেন

বুক রিভিউ: মেমসাহেব - নিমাই ভট্টাচার্য

বুক রিভিউ : ‘বৃষ্টি ও মেঘমালা’—হুমায়ূন আহমেদ

প্রলাপা’য়োজন -০৪ | সামি আল সাকিব