বুক রিভিউ: যাপিত জীবন - সেলিনা হোসেন

বইয়ের প্রচ্ছদ*

বই-পর্যালোচনা :          ( ১ ) 

১৯৪৭ সাল। ভারতবর্ষ ভেঙে ধর্মভিত্তিক দুটো নতুন রাষ্ট্র হয়। আর হয় দাঙ্গা। রক্তক্ষয়ী হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার শিকার হয়ে তিল তিল করে গড়ে তোলা সাজানো-গোছানো জীবন রাতের আঁধারে সদ্য স্বাধীন দেশ পূর্ব পাকিস্তানে পালিয়ে আসেন স্থানীয় স্কুল শিক্ষক, নিসর্গবেদী মাঝ বয়সী সোহরাব আলি, স্ত্রী আফসানা খাতুন, পুত্রত্রয় মারুফ,জাফর এবং দীপু।

বন্ধু দীপেনের আত্মীয়তার সূত্রে খুব একটা ঝামেলা ছাড়াই মাথা গুঁজবার মতো বেশ ভালো একটা ঠাই হয় তাদের। বিরাট আঙিনা, বাগান আর ছায়াঘেরা কলকাকলি মুখর এক দ্বীতল বনেদি বাড়ি। সবুজে ঘেরা বাড়িটাই হয়ে ওঠে তাদের নতুন ঠিকানা।
তারা আবার নতুন করে তাদের সংসার,জীবন,বাড়ি আর স্বপ্ন সাজাবার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠেন।

বড়ছেলে মারুফ যোগ দেয় চাকুরিতে। মেজোছেলে জাফর ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আর ছোটছেলে দীপু ভর্তি হয় স্কুলে। সোহরাব আলি আবার ফিরে যেতে থাকেন তার পুরোনো জীবনে, নিসর্গবেদী, শখের হেকিম, কাজের মাধ্যমে গরিব দুঃখীর উপকারে নিবেদিতাপ্রাণ জীবনে, তার গাছগাছালির সংসারে। আর আফসানা খাতুন ভীত অথচ দৃঢ় হাতে আগলে রাখেন তার পরিবার, তার সংসারকে।

এতো কিছুর মাঝেও কেমন এক শূণ্যতা তাদের পোঁড়ায়। একটা মেয়ের খুব শখ ছিলো তাদের। পূরণ হয়নি। বড়ছেলে মারুফ নিজেকে কেমন নিজের ভেতর গুটিয়ে নিতে থাকে। ওর চোখের দিকে তাকালে জমাট দুঃখের সাগর ফুটে ওঠে। তার দুঃখ ঘুচবার অপেক্ষায় প্রহর গোণে সবাই। ছোটছেলে দীপু সারাদিন গাছ,ফুল আর বাগানে হুটোপুটি খায়, ছুটে চলে প্রজাপতির পেছনে। ক্লান্ত হলে ছুটে এসে মুখ লুকোয় আফসানা খাতুনের আঁচলে। মেজোছেলে জাফর। তার দ্বরাজ গলার কবিতা প্রাণ ছুঁয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা, স্বদেশ, স্বাধিকারের প্রশ্নে আপোষহীনতা আর জীবনবাদী এক উচ্ছ্বল তরুণ।


                                   ( ২ )

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর নেমে আসে ষড়যন্ত্রের কালো ছায়া। প্রথম আঘাতটা আসে মাতৃভাষা বাংলার ওপর। তৎকালীন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা এবং ক্ষুদ্র অংশের ভাষা উর্দু হওয়া সত্বেও শাসকগোষ্ঠী জোর করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর পায়তারা করতে থাকে।

মাতৃভাষার প্রতি আঘাত বাঙালিকে বুঝিয়ে দেয়, তারা হিন্দু বা মুসলিম তা যতখানি সত্য, তার চাইতেও বেশি সত্য তারা সকলেই বাঙালি এবং প্রকৃতি তাদের চেহারায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ রেখেছে যা মালা, টিকি, তিলক কিংবা টুপি, তসবিতে ঢাকবার জো নেই। তারা বুঝতে পারে তাদের আত্মপরিচয়ের ওপর আঘাত এসেছে, আসছে, আসবে। তাদের এটা থামাতে হবে। শুরু হয় প্রতিবাদ। শাসকগোষ্ঠী তবু থামে না, ষড়যন্ত্র চলতেই থাকে। বাঙালিরাও চালিয়ে যেতে থাকে আন্দোলন। জাফর,সোহরাব আলিও এর বাইরে নয়। ভাষা আন্দোলন তাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ধীরে ধীরে জাফর যুক্ত হয় বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে, একসময় তার ধ্যানজ্ঞান সবটা জুড়ে বসে বাংলা ভাষা, বাঙালির অধিকার রক্ষায় আত্ম-নিয়োজন।

এর মাঝে জাফরের জীবনে আগমন ঘটে আঞ্জুমের। এমনভাবে সে জাফরের হৃদয় স্পর্শ করে যা ফিরাবার শক্তি তার নেই। আঞ্জুমের আগমনে নতুন করে গতি পায় জাফর। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে আপোষহীন জাফর আঞ্জুমের মতো সঙ্গী পেয়ে আরো দৃঢ় হয়ে ওঠে।
সময় গড়ায়। আন্দোলন চলে,শাসকগোষ্ঠী নিত্যনতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে থাকে। এরই মাঝে দীপু বেড়ে হয়ে ওঠে। গাছগাছালির পাশাপাশি সে এখন বাইরের দুনিয়া,দেশ,ভাষার অধিকার নিয়ে সোচ্চার। বেশ বড় হয়ে গেছে সে।

ওদিকে মারুফের মাঝে উচ্ছ্বলতার আভাস ফুটে ওঠে। জানা যায় বন্ধু-বোন সুমনার কাছে হৃদয় হারিয়ে ফেলেছে সে। তার জীবনে যেন বসন্ত ফিরে আসে। তার খুশিতে খুশি হয় পুরো পরিবার। ওদিকে বাড়িতে একটা মেয়ের অভাব তো ছিলোই। সবাই বেশ সানন্দেই মারুফ-সুমনার বিয়ে করিয়ে দেয়। সুমনার উপস্থিতিতে যেন নতুন করে প্রাণ পায় তাদের বাড়িটা, নতুন করে বাঁচতে শেখে সবাই।

সোহরাব আলি এক নতুন স্বপ্নে বিভোর হয়। তিনি স্বপ্ন দেখেন গরিব-দুঃখীর দুঃখ-কষ্ট লাঘব, দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির উৎকর্ষ সাধনে একটা আয়ুর্বেদিক হাসপাতাল বানানোর। নানা জায়গায় ধর্না দিয়েও যখন কাজ হয় না তখন নিজেই লেগে পড়েন তার কাজে। পরিবার, শিক্ষকপ্রতীম অভিজ্ঞ হেকিম বদরউদ্দিনের সমর্থন এবং আর্থিক সহায়তায় আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে তার স্বপ্ন, তার আয়ুর্বেদিক হাসপাতাল।
সোহরাব আলির দিন কাটে তার হাসপাতাল এবং আগত রোগীদের সেবা শুশ্রূষার মাঝেই। একদমই দম ফেলার ফুরসত নেই। ওদিকে কেমন এক অসুখ বাঁধে আফসানা খাতুনের। রাত করে জ্বর আসে,ভোর হলে গায়েব। অযথা কাউকে দুশ্চিন্তায় ফেলার ভয়ে চেপে যান সেটি। অসুস্থ হয়ে পড়েন সোহরাব আলি নিজেও।

সময়টা ১৯৫০এর পরের কথা। শাসকগোষ্ঠীর ইন্ধনে ধর্মের দোহাই দিয়ে বীভৎস রূপে খুন,সম্ভ্রমহানি আর লুটতরাজ চলে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর। মূল উদ্দেশ্য ভাষার প্রশ্নে বাঙালিকে বিরত রাখা।বাঙালি জাতি বুঝতে পেরে আরো সোচ্চার হয় নিজেদের অধিকার রক্ষায়। পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে ষড়যন্ত্র।

১৯৫২ সাল। বাংলা ভাষার প্রতি আসে চূড়ান্ত আঘাত। বাঙালি জাতি, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতি নিতে থাকে চূড়ান্ত  প্রতিরোধের। দেশজুড়ে ১৪৪ধারা জারি করে সরকার। ভাষার প্রশ্নে আপোষহীন আন্দোলনকারীরা সিদ্ধান্ত নেয় যেকোনো মূল্যে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার। তারা ১৪৪ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। এই মিছিলে যোগ দেয় আঞ্জুম, জাফর, দীপু। প্রথমে মেয়েদের দল মিছিল বের করে। সেই দলে আঞ্জুম ছিল। পুলিশ পিটিয়ে ছত্রভঙ্গ করতে চাইলেও ব্যর্থ হয়ে কাঁদানে গ্যাস প্রয়োগ এবং গণহারে গ্রেফতার শুরু করে। গ্রেফতার হয় আঞ্জুম। ওদিকে জাফরের দল মিছিল বের করার পর শিকার হয় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস আক্রমণের। এসবে যখন তারা ছত্রভঙ্গ এবং দিশেহারা হয়ে তখন হঠাৎ করে গুলি চালাতে শুরু করে পুলিশ। জাফর তখন কাঁদানে গ্যাসের আঘাতে চোখে ঝাপসা দেখছে। মুহূর্তেই লাশ হয়ে যায় অসংখ্য শিক্ষার্থী। চলে তাণ্ডবলীলা।

মিছিল শেষে বাড়ি ফেরে দীপু। হাতে-পায়ে লাঠির আঘাত,চোখে কাঁদানে গ্যাসের জ্বালাপোড়া। রাত বাড়ে,তবু জাফর আর ফেরে না। মারুফ খোঁজ নিতে হন্তদন্ত হয়ে ছোটে। ব্যস্ত পায়চারি আর উৎকণ্ঠার রাত শেষ হয়। অবশেষে খোঁজ পাওয়া যায় জাফরের।

সোহরাব আলি উদভ্রান্তের মতোন আফসানা খাতুনকে সাথে করে বাগানে এসে কী যেন খুঁজতে শুরু করেন। কাউকে খুঁজতে থাকেন অনবরত। পান না। ব্যথা সারাবার ঔষধ খোঁজেন, মনের ব্যথা। পান না। তবু হাতড়াতে থাকেন দ্ব্যর্থহীন।

পরদিন মুক্তি পায় আঞ্জুম। বেরোয় বিশাল মিছিল। ভাঙা হাত-পায়ের আঘাত নিয়ে আবারো মিছিলে যায় দীপু। লক্ষ লোকের বিশাল মিছিল। যার শুরু এবং শেষ নেই। কালো পতাকা ছাড়াও ওড়ে শহীদের রক্তমাখা কাপড়। স্লোগানের শব্দে দ্রুত বড় রাস্তায় চলে আসে সোহরাব আলি। পেছনে পড়ে থাকে সরু গলি,বাগান, বাড়ি। মিছিলে প্রকম্পিত হতে থাকে গোটা শহর। শহীদের জামাটা চিনতে ভুল হয় না তার। মিছিল দেখতে দেখতে কখন মিছিলে যোগ দিয়ে স্লোগান দিতে আরম্ভ করেছেন সে খেয়াল নেই। তিনি বুঝতে পারেন তার হৃদয় এখন ভারমুক্ত। ওদিকে মিছিলের দিকে তাকিয়ে গতদিনের ঘটনা বিশ্বাস করতে পারেনা আঞ্জুম। বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকে, তোমাকে আমি কিছুতেই মরতে দেবো না মিছিল...।

                                  -----

             বই :  'যাপিত জীবন'
         লেখক :  সেলিনা হোসেন
প্রথম প্রকাশ :  ২০১২ সন (পরিমার্জিত)
      প্রকাশক :  ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ
 পাতা সংখ্যা :  ৩০৪ টি
            ধরণ : ভাষা আন্দোলন আশ্রিত কাল্পনিক                                উপন্যাস
             
                                 ▫▫▫▫▫


আমার জীবনে পঠিত অন্যতম সেরা বই এটি। বইটা এতোটাই সুখপাঠ্য যা ব্যাখার মতো ভাষা আমার নেই, তাই আমি যেমনটা চেয়েছিলাম, যতটুকু ভালো আলোচনা হওয়া উচিৎ ছিলো, আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, আমি ক্ষমাপ্রার্থী । বইটির ২৫৪-২৬১পাতাগুলো আমি পড়েছি আর অঝোরে কেঁদেছি। বই পড়ে কাঁদার ঘটনা আমার জীবনে এটাই প্রথম। আশা করবো পাঠক-অপাঠক যারাই বইটি পড়বেন বইটি তাদের আষ্ঠেপৃষ্ঠে মায়ার বাঁধনে বাঁধবে। ]


©সামি আল সাকিব |২০২০
#পৃথিবী_বইয়ের_হোক📚

                    

Comments

Popular posts from this blog

বুক রিভিউ: মেমসাহেব - নিমাই ভট্টাচার্য

বুক রিভিউ : ‘বৃষ্টি ও মেঘমালা’—হুমায়ূন আহমেদ

প্রলাপা’য়োজন -০৪ | সামি আল সাকিব