বুক রিভিউ: দাঁড়কাক - শওকত হোসাইন

বইয়ের প্রচ্ছদ

•              বই :  'দাঁড়কাক'
          লেখক :  শওকত হোসাইন
 প্রথম প্রকাশ :  ২০২০ সন
       প্রকাশক :  ঘাসফুল প্রকাশনী
  পাতা সংখ্যা :  ১২৭ টি
             ধরণ :  সমকালীন উপন্যাস

পাঠ-অনুভূতি : দাঁড়কাক। পাখিরাজ্যের এই পাখিটা কখনো পাখির মর্যাদা পায়নি।  কোনোদিন হয়তো পাবে এমন আশাও ক্ষীণ। এতো বড় রাজ্যের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সে বড্ড বেশি একা, নিঃসঙ্গ। ঠিক যেন পাশাপাশি দুটো কবরের মতো। আর মানুষ? মানুষ এর চাইতেও একা।

আমরা সবসময় একটা সুন্দর সাজানো-গোছানো সংসার-জীবনের স্বপ্ন দেখি। ঠিক ছবির মত সুন্দর। আমাদের দিন-রাত,বেলা সব এই স্বপ্নকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। অন্তত সাধারণ মানুষের জীবনটা এমনই। কিন্তু মানুষ যা চায় তার সবই কি পায়? পায় না। মাঝমাঝে চোখ পড়ে শকুনের। আস্ত গিলে খায় ছবির মতো সাজানো জলজ্যান্ত স্বপ্নকে, স্বপ্নের মানুষকে। শ্মশান বানিয়েই কেবল এরা দম নেয়।

ব্যস্ত ঢাকার বুকে একটুকরো স্বর্গ 'রেহানা মঞ্জিল'। পল্লিগাঁয়ের আদর্শ বাড়ি বলতে চোখে যা ভাসে, ঘনবসতির ঢাকায় তা দুঃস্বপ্ন হলেও বাড়িটা ঠিক তাই। বড় আঙিনা, শান বাঁধানো পুকুর,ছিমছাম ছোট্ট দোতলা বাড়ি। যে কারো জন্যেই লোভ জাগানীয়া। এই বাড়িতেই বাস করেন পেশায় ইনস্যুরেন্স কোম্পানির কর্ণধার - কর্তা রাশেদ রহমান, একজন আদর্শ মানুষ বলতে চোখে যা ভাসে তিনি ঠিক তাই, গৃহিণী স্ত্রী রেহানা এবং তাদের সদ্য কৈশোরে পা দেয়া ছেলে অপু। আরো আছে গৃহকর্মী আমেনা এবং দাড়োয়ান শাহজাহান। এদেরকে ঘিরেই উপন্যাসের আখ্যান।

একদিন রাতে রাশেদ রহমান অফিস শেষে আর বাড়ি ফেরেন না। স্ত্রী রেহানা উদ্বিগ্ন হলেও ধৈর্য্য ধরে থাকেন,ভাবেন রাত ফুরোলেই ফিরবেন তার জীবনসঙ্গী। রাত ফুরিয়ে দিন হয়,দিন ফুরিয়ে রাত। রাশেদ রহমান আর ফেরেন না। তটস্থ রেহানা খবর দেন রাশেদ রহমানের ভাই, ঢাবি শিক্ষার্থী ও তরুণ রাজনৈতিক আতিককে,যার দিন কাটে দেশ এবং রাজনীতিকে আবর্তন করেই। খবর পেয়ে সে তার ভাইকে খুঁজতে থাকে। জানানো হয় মিরপুর থানার ওসিকেও। হাসপাতাল, গোরস্থান,থানা সব জায়গাতেই প্রত্যেকদিন খোঁজ চলে। তবুও খোঁজ পাওয়া যায় না রাশেদ রহমানের। যেন ভোঁজবাজির মতোন হাওয়া হয়ে গেছে। এদিকে পিতার অনুপস্থিতিতে অপুর মাঝেও কেমন এক বিশৃঙ্খল, বড় হয়ে যাওয়ার মত আচরণ ফোটে। এসব দেখে ভেঙে পড়েন এতিম রেহানা,যার শেষ সম্বল কেবল স্বামী-সন্তান।

এদিকে রাশেদ রহমানকে সেদিন অফিস থেকে বেরোতেই চকবাজার থানার পুলিশ আটক করে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানি চালানোর কারণে পুলিশের সাথে লেনদেন তার স্বাভাবিক মনে হয়। তাকে না দেখিয়েই মুক্তি দেয়ার কথা বলে সই করিয়ে নেয়া হয় কতগুলো কাগজ। সই হয়,তবু মুক্তি মেলে না তার। তার ঠাঁই হয় কেন্দ্রীয় কারাগারে। ফাঁসির আসামিদের বিশেষ সেলে। তিনি ভাবতে থাকেন, এমন কোনো অপরাধ তিনি করেননি যার জন্য তার ফাঁসি হতে পারে। এখানে তার সেল সঙ্গী এক ভদ্রগোছের রাজনীতিবিদ এবং এক কৃষক। তারাও ফাঁসির আসামি। হঠাৎ একদিন সেই ফাঁসির আসামি রাজনীতিবিদ মুক্তি পায়। মুক্তির সময় রাশেদ রহমানকে বলে যায় এমন কিছু কথা যা শুনে তার মনে হয় পায়ের নিচ থেকে মাটি সড়ে যাচ্ছে।

রাশেদ রহমান অফিসের ম্যানেজার আলতাফকে কথা দিয়েছিলেন তার বোনের বিয়েতে উপস্থিতি থাকবেন। তার আগেই তিনি গায়েব। তার অনুপস্থিতিতে বোনের বিয়ে হবে না বলে কসম করেছিলেন আলতাফ। বিয়েটা আর হয়না। বোন শায়লাকে নিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। সামলাতে থাকেন অফিস এবং অন্যান্য সব। এদিকে ঢাকায় শায়লার জন্য এক ভালো পাত্রের সন্ধান পাওয়ায় ও রাশেদ রহমানের হারানোর দীর্ঘতায় আবারো বিয়ের আয়োজন হয় শায়লার। এদিকে শায়লার হৃদয়ে আতিকের জন্য মায়া জমে,সম্ভবত মায়ার চাইতে বেশি কিছু। আতিকের মনেও জমে। এগোতে গিয়েও ফিরে আসে হঠাৎ।

এদিকে রেহানা স্বামী হারিয়ে পুত্রকে শেষ সম্বল করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন। হঠাৎ পুত্রের কেমন রোগ হয়। হঠাৎ করেই একদিন তার মৃত্যু হয় তার।

এদিকে আতিকের রাজনৈতিক জীবনে ভয়াবহ বিপদ নামে। তাকে পালাতে হয় রাজনীতি ছেড়ে,শহর ছেড়ে, সবকিছু ছেড়ে একদম একা। স্টেশনে গিয়ে সে ট্রেনে ওঠে। জীবনটা একা কাটানোর কথা ভাবতে থাকে সে,কিন্তু না। তার সফরসঙ্গী পাওয়া যায়। তারা যে বাড়িতে পালিয়ে থাকবে তার ব্যবস্থা আগে থেকেই করা। গোপনে কেউ তার সফরসঙ্গীর নামে বাড়িটি কিনে দিয়েছেন।

রেহানা মঞ্জিলে একটা কবর খোঁড়া হয়, অপুর জন্য। রেহানা ভাবতে থাকেন। তিনি আজ আবারো একা হলেন। এরমাঝেই বাড়ির বাইরে এম্বুলেন্স থামে। আরেকটা লাশ আসে। লাশটা রাশেদ রহমানের। তার ফাঁসি হয়েছে। হুজুররা একটা লাশ মাটি দিতে এসে দুটো লাশ পায়। দুটো কবর হয় রেহানা মঞ্জিলে। রেহানা কবরের দিকে চেয়ে থাকেন। তিনি আজ বড্ড একা হয়ে গেছেন। এতো ভীড়,প্রাচুর্যের মাঝেও তিনি একা। পাশাপাশি দুটো কবর অথচ কি ভীষণ নিঃসঙ্গতা। ঠিক যেন দাঁড়কাকের মতোন।

নিঃসাড়, নিঃসঙ্গ রেহানা কবর পানে চেয়ে থাকেন। রাত-বিরেতে সাদা শাড়ি পড়ে পুকুরঘাটে গিয়ে বসে কী যেন ভাবেন,কান্না করেন।

বাড়ির বারান্দায় দাড়িয়ে এসব দেখে একজন। সম্ভবত কিছু একটার জন্য অপেক্ষা। কীসের অপেক্ষা? সম্ভবত প্রায়শ্চিত্তের অপেক্ষা। কীসের প্রায়শ্চিত্ত? কে সে?

এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে পড়তে হবে জনপ্রিয় তরুণ লেখক 'শওকত হোসাইন' এর নতুন উপন্যাস 'দাঁড়কাক'। এটি কেবলই একটি উপন্যাস নয়। মানুষ,মানুষের জীবন,জীবনের গল্প। একটা দাঁড়কাকের জীবনের গল্প। প্রত্যেকটা মানুষের অজানা গল্প।


• উপন্যাসের একটা ম্যাজিক বাক্য -

             "বাসটা থামে আলতাফের পাশেই। 'মৌমিতা এক্সপ্রেস'। তিনি বাসে উঠেন, সাথে শায়লা। সে গন্তব্য জানে না। জীবনে কখনও এরকম হয়! মানুষ যাচ্ছে অথচ গন্তব্য জানে না। "
       
                                       ---


#পৃথিবী_বইয়ের_হোক📚
© সামি আল সাকিব

Comments

Popular posts from this blog

বুক রিভিউ: যাপিত জীবন - সেলিনা হোসেন

বুক রিভিউ: মেমসাহেব - নিমাই ভট্টাচার্য

বুক রিভিউ : ‘বৃষ্টি ও মেঘমালা’—হুমায়ূন আহমেদ

প্রলাপা’য়োজন -০৪ | সামি আল সাকিব