বুক রিভিউ: আঙ্গারধানি | কিঙ্কর আহ্সান

•  পাঠ-অনুভূতি : আঙ্গারধানি। যে পাত্রে আগুনের ফুলকি, জলন্ত কয়লা রাখা হয়। আমাদের হৃদয়'টাও এক একটা আঙ্গারধানির মতোন। সেখানে আমরা খুব সযত্ন পুষে রাখি আমাদের সুখ-দুঃখ, পাওয়া-না পাওয়া আর যতকিছু আমাদের পোড়ায়, আমাদের ফুরায় - সব।

আলগী নদীর তীরবর্তী এক গ্রাম। এই গ্রামের শাশ্বত এক পরিবারের সর্ব-কণিষ্ঠ সন্তান পারুলকে একদিন বাড়ির পেছনে আঁধারে ঢাকা কবরস্থানে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। এই ছোটবোনটি তাদের তিন ভাইবোনের মাঝে সবার বড়, ভাইজানের খুব আদরের। তার মৃত্যুর খবরে আট বছর ধরে বাড়ি ছেড়ে পালানো ভাইজান হঠাৎ ফিরে আসে। আর আসে নিশা আপা। লেখকের এবং একইসাথে লেখকের বড় ভাই যার প্রেমে পড়ে গেছিলো, লেখক বয়সে বেশ ছোট বলে পাত্তা না পাওয়া, মা মরা তাদের অসহায় এবং একইসাথে সহোদর খালাতো বোনের। আর আছে কমলেশ, লেখকের বাল্যবন্ধু, মাটির মায়ায় বিদ্ধ এক শাশ্বত পল্লিগাঁয়ের মানুষ।

ভাইজানের বাড়ি ফেরায় অনেক অনেক প্রতীক্ষার অবসান হয়, শুরু হয় এক নতুন লড়াই। এ লড়াইটা মনস্তাত্ত্বিক। ভাইজান প্রতিনিয়তই কিছু লুকিয়ে যাচ্ছেন, অনেক অনেককিছুই লুকিয়ে রাখছেন নিজের কাছে। এদিকে সদা উচ্ছ্বল নিশা আপাও ভাইজানকে পেয়েও নির্লিপ্ত। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য টানাপোড়ন। যাতে জড়িয়ে যায় লেখকের সাবলীল জীবন, ছেঁদ ঘটে জীবনের। প্রতিটা মুহূর্তে লেখক এসব ছেড়ে পালাতে চান, চান একটা সুন্দর, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন। অথচ পারেন না। মানুষ একজীবনে সবকিছুর বিনিময়ে কেবলই শান্তি চায়। অথচ শান্তি মানুষের চির আরাধ্যই থেকে যায়। তাকে ধরে রাখা যায় না। লেখকও পারেনি। তার বদলে সঙ্গী হয়ে বিষাদ-বেদনা। যা জমে আছে হৃদয়ে। রোজ নিয়ম করে পোড়াচ্ছে। হৃদয় যেন হয়ে উঠেছে আঙ্গারধানি।

গল্প এগোয়, ভাইজানের কী এক অসুখে দিন দিন অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। এদিকে বিবাহিত নিশা আপা গর্ভবতী হয়ে দিন গোণে আপনসত্ত্বাকে আলো দেখাবার। ওদিকে কমলেশের তীব্র বিরোধ সত্ত্বেও তার পিতা দেশে তাদের সকল সম্পত্তি বিক্রি করতে শুরু করে। জানায়, আত্মীয়ের অন্তিম সাধ পূরণে গোটা পরিবার নিয়ে কোলকাতা যাবার তোড়জোড় বলে। অথচ জানা যায়, তিনি পুরো পরিবার নিয়ে থিতু হতে চলেছেন সেখানে। এসবের মাঝে থেকে লেখকের আঙ্গারধানি যেন ফুঁটো হয়ে যায়। যেখান থেকে গলে পড়তে থাকে সব আঙ্গারগুলো।

দেখতে দেখতে ভাইজানের ফিরে যাবার সময় এসে পড়ে। তার আগেই জানা যায় তার অসুখের কথা। আট বছর আগে বাড়ি ছেড়ে পালাবার কারণ, নিশা আপার সাথে ঘটে যাওয়া ভয়ংকর ঘটনা, লেখকের তোড়জোড় আঙ্গারধানি থেকে মুক্তির। নিশা আপার সন্তান প্রসবের নির্ধারিত সময় এগিয়ে আসে।

ভাইজান ফিরে যাবার আগে নিশা আপার শ্বশুরবাড়ি গেলেন বেশ রাতে, নিশা আপার সাথে দেখা করতে, বাড়ি ফেরার পর থেকে যাকে তিনি এড়িয়ে গেছেন প্রতিবার, নির্লিপ্ত থেকেছেন নিশা আপা নিজেও। ভাইজানকে নৌকা করে নিশা আপার বাড়ি অবধি এগিয়ে তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে নৌকায় বসে বসে অশুভ কিছুর আশংকা করছেন লেখক। কিছুক্ষণ পরই শুনতে পেলেন এক তীব্র নারী চিৎকারের। তিনি দৌড়ে গেলেন।

লেখক এখন মুক্ত। তিনি বাড়ি ছেড়ে, সকল আঙ্গার জমা হৃদয়ধানি থেকে নতুন জমা হওয়া আঙ্গার, তার পরিবার, গ্রাম, বন্ধু আর বাকি সব কিছু থেকে দূরে, অনেক দূরে আছেন। আঙ্গারধানিতে আর নতুন কোনো আঙ্গার জমেনি। পুরোনো আঙ্গারগুলো দিনের ভীড়ে লেখককে পোড়াবার সুযোগ পায় না আর। তবু দিনান্তে আঙ্গারগুলো হঠাৎই জ্বলে ওঠে। পোড়াতে শুরু করে। আর লেখকের সাথে সাথে জ্বলতে থাকে আঙ্গারগুলো, হৃদয় যেন একেকটা আঙ্গারধানি হয়ে ওঠে তখন..


•              বই :  'আঙ্গারধানি'

          লেখক :  কিঙ্কর আহ্সান

          প্রকাশ :  ২০১৯ সন

       প্রকাশক :  অন্যধারা প্রকাশনী

  পাতা সংখ্যা :  ৭৯ টি

             ধরণ :  চিরায়ত উপন্যাস


                                          ----

©সামি আল সাকিব

#পৃথিবী_বইয়ের_হোক📚



 

Comments

Popular posts from this blog

বুক রিভিউ: যাপিত জীবন - সেলিনা হোসেন

বুক রিভিউ: মেমসাহেব - নিমাই ভট্টাচার্য

বুক রিভিউ : ‘বৃষ্টি ও মেঘমালা’—হুমায়ূন আহমেদ

প্রলাপা’য়োজন -০৪ | সামি আল সাকিব