চিঠি-অংশ | ‘অর্ধেক জীবনের অর্ধেক ভ্রম(ণ)’


❝ কেমন আছো? উত্তরটা আমি জানি। তুমি কোনোদিন স্বীকার করোনি সত্য, তবু হৃদয়ে হৃদয়ে যে মেল আমাদের, তা নিশ্চয়ই অস্বীকার করবে না আর। সেই সংযুক্তি থেকেই আমি জানি, তুমি কেমন আছো। 

তুমি সবসময় বলতে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এমন একটা বাক্য যা মুখে নয়, হৃদয়ের নীরবতা দিয়ে শুনতে হয়, শোনাতে হয়, অনুভব করতে হয়। এজন্যই বোধকরি কোনোদিনও তুমি মুখ ফুটে বলো নি। তবু আমি কীভাবে কীভাবে যেন টের পেয়ে গেছি, জেনে গেছি। যেহেতু আমাদের সংযোগ হৃদয়ের, তুমি নিশ্চয়ই জানো, আমি তোমাকে ঠিক কতটা, কতটা উন্মাদের মতো ভালোবাসি। এতোক্ষণে এটুকুও নিশ্চয়ই জেনে গেছো, আমি তোমাকে সুতীব্রভাবে যতখানি ভালোবাসি, তার চাইতেও অনেক অনেক বেশি ঘৃণা করতে শুরু করেছি। সবচেয়ে পছন্দের, সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে যখন মানুষ ঘৃণা করতে শুরু করে, তা কতটা তীব্রতা নিয়ে আছড়ে পড়ে তা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয় লেখক সাহেব! 

তুমি জানো! তুমি কতটা অসহায়, নির্জীব আর কাপুরুষ! তুমি কতটা দরিদ্র হৃদয়ের একজন অ-মানুষ, তোমার কোনো ধারণা আছে? নেই। থাকলে খুব সম্ভবত আজ তুমি নিঃসঙ্গতম, নিঃসাড় প্রাণী হয়ে রাতের আঁধারে হেঁটে ফিরতে না আর। 

শুরু থেকেই আমরা দু’জনে বিপরীত দুই মেরুর মানুষ ছিলাম। তুমি অন্তর্মুখী, গম্ভীর আর নিজের তৈরি কল্পলোক হাতড়ে বেঁচে ফেরা এক নিতান্তই সাধারণ-অসাধারণ রূক্ষ পুরুষ, তোমার ভাষায়, কৃষ্ণতর রূক্ষ পুরুষ। অপরদিকে দশহাজার মাইল দূরের এক বরফাচ্ছাদিত পিতৃভূমি থেকে মায়ের জন্মভূমি বেড়াতে আসা এক প্রাণোচ্ছল তরুণী, আধো আধো বাংলা বোঝা, রীতিনীতি আর কৃষ্টি-সংস্কৃতি, পরিবেশ, সমাজ আর পথঘাট না চেনা তৃষ্ণার্ত এক মেয়ে নেহাত’ই কাকতালীয়ভাবে একসময় তোমার প্রতিবেশী হয়ে ওঠে। তারপর একসময় তোমার কথার জাদু, মুনশিয়ানায় বাঁধা পড়ে তোমার সবচেয়ে কাছের সঙ্গী হয়ে ওঠে মেয়েটি।
 
প্রতিবার ছুটিতে এসে তোমার সাথে সাথে দেশের পথঘাটে ঘুরে-বেড়াতে গিয়ে কখন যেন দুজনেই হৃদয়ের বাঁধনে আটকা পড়ে যায়। অথচ এই বাঁধন, মায়ার টান লুকোবার কি নিদারুণ প্রচেষ্টা দুজনার! লুকোচুরি এই খেলা কি কেবলমাত্র হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের যোগাযোগ মজবুত করারই অংশ ছিল? উত্তরটা হচ্ছে না। শত প্রতিবন্ধক, বিভাজক আর বৈসাদৃশ্যতা ছিল আমাদের। সমাজ, ধর্মবিশ্বাস, দেশ, জাতীয়তা, মতাদর্শ, ব্যক্তিত্ব, ভাষা, রুচিবোধ, সামাজিক অবস্থান - কোনো কিছুই সহায় ছিলো না আমাদের। কোনোদিনই না। তারপরও তো আমরা কাছে ছিলাম, পাশে ছিলাম, হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের বন্ধন তৈরি করতে পেরেছিলাম। 

তবু, জানো তো! কিছু কিছু সময় আসে যখন মানুষ স্বীকৃতি খোঁজে, কিছুটা নির্ভারতার প্রশান্তি খোঁজে, হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলে কিংবা খুশির খবর পেলে একটা মানুষ খোঁজে জড়িয়ে ধরবার, তার প্রতি মুগ্ধ হবার একান্ত একজন নিজের মানুষ খোঁজে। আমার সেই মানুষটা তুমি। দিনকেদিন তুমি আরো পরিণত হচ্ছিলে, আর ওদিকে আমি গভীর থেকে গভীরে ডুবে যাচ্ছিলাম তোমার মুগ্ধতায়। যদিও, আজ বুঝতে পারছি। তোমার কথার মুনশিয়ানা আর লেখনীর জাদু কেবলই গালগল্প আর ধাপ্পাবাজি। তোমার লেখনীতে তুমি নিজেকে যতটাই বীর আর প্রেমিক সুপুরুষ সাজাও না কেন, বাস্তবে তার বিন্দুমাত্র প্রতিফলন ঘটাবার সামর্থ্য তোমার নেই, তুমি মূলত একজন কাপুরুষ। কাপুরুষরা যেহেতু আর কিছু পারে না, তারা স্বপ্ন দেখে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে, গল্পে নিজেকে সাহসী-বীরপুরুষ সাব্যস্ত করে। তুমি তাদেরই দলের।

যদিও আমি এতোসব কিছু জানা সত্ত্বেও দিনের পর দিন সেই কাপুরুষটাকে ভালোবেসে এসেছি। জানোই তো! ভালোবাসি’র কখনো অতীত হয় না। একটা হৃদয় একবারই দেয়া যায়। 

আমি শেষ মুহূর্ত অবধি অপেক্ষায় ছিলাম কোনো দৈব ঘটনার সাক্ষী হতে। অপেক্ষায় ছিলাম, কাপুরুষতার শিকল ভেদ করে অন্তত তুমি এগোবে। আমাদের হৃদয়ের যে বন্ধন তার একটা স্বীকৃতির যে নীরব দাবি করে গেছি এতকাল, তার জন্য হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়বো। একটা মাত্র জীবন আমাদের। চলে গেলে আর ফিরে আসা হবে না, একটা জীবন বাঁচার মতো করে তোমায় সঙ্গী করে বাঁচতে চেয়েছিলাম। অথচ তুমি যেন ভোঁতা, কাপুরুষ, মূকমানব। একটাবার যদি মুখ ফুটে বলতে, এসো বাঁচি, এসো। বিশ্বাস করো, আমি কখনোই আসতে পারতাম না তোমাকে ছেড়ে। তুমি ভাবছো, তোমারই মন পোড়ে শুধু! না। কেন ভুলে যাও আমারও একটা হৃদয় আছে। প্রাণোচ্ছলতা ছাড়াও আমারও দুঃখ-বেদনা আর না পাবার গ্লানি আছে। তবু, তোমার সে সাহস হলো না আর..

তোমাকে বলার মতো আর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। মিথ্যে বললাম, আসলে অনেক অনেক কথা, অভিমান, অভিযোগ আর অনুযোগ জমে গেলে মানুষ নীরব হয়ে যায়, কথা শূণ্যতায় ভোগে। এই মুহূর্তে আমি কথার, শব্দের, বাক্যের দারিদ্রতায় ভুগছি। পৃথিবীতে এরচেয়ে ভয়ংকর ব্যাধি খুব কমই। আচ্ছা, অভিমান তো মানুষ কেবলমাত্র তার নিজের মানুষের সাথেই করে, করতে পারে। তুমি যে আমার নিজের মানুষ! তুমি এসব জানো নিশ্চয়, তাই আর কথা বাড়াচ্ছি না, চাইলেও আর পারছি না।

আমার কিংবা আমার পরিবারের কারো সাথে আর যোগাযোগের চেষ্টা করবে না। করে লাভ হবে না কোনো। সবকিছু বদলে ফেলেছি আমি। বলতে পারো, বদলাতে বাধ্য হয়েছি। চির প্রতীক্ষার পরও যা আমার জীবনের অংশ হলো না, সেই প্রত্যাশা থেকে কিছুটা নিস্তার চাই। কিংবা বলতে পারো, পালিয়ে বাঁচতে চাইছি, নিজের থেকেই নিজে পালিয়ে।

মানবজীবন পুরোটাই রহস্যেঘেরা। একজীবনে মানুষের সব সাধ কি পুরো হয়? হয় না। অনেকের জীবনই আক্ষেপে কেটে যায়। জীবন তো আর খুব দীর্ঘ কিছু নয়। আমারও স্বল্পায়ুর জীবন। কোনো না কোনোভাবে কেটে যাবে নিশ্চয়ই। এ নিয়ে ভেবে আর নিজের বোঝা বাড়িও না। 

আমি জানি, সামান্য অর্থকষ্ট পেলেও তুমি কতটা গ্লানি আর অসহায়তায় ভোগো। জীবন সঙ্গী হয়তো হওয়া হলো না এই জীবনে, তবু তুমি যে আমার শৈশব-কৈশোরের সেরা বন্ধু, সে কথা অস্বীকার করবার জো’টিও নেই। আমার অর্থ-বিত্ত থাকতে আমার শৈশব-কৈশোরকে রাঙিয়ে তোলা বন্ধুটি অসহায়তায় ভুগবে, এটা মেনে নিতে কষ্ট হবে খুব। তাই চেকবই টা তোমার জন্য রেখে গেলাম। প্রয়োজন হলে অঙ্ক বসিয়ে অর্থ তুলে নেবে। আমি জানি, কারো কাছ থেকে হাত পেতে নিতে তোমার কতটা ঘৃণা। তবু, তুমি না বলতে, ‘তোমার কাছ থেকে নিতে আমার আপত্তি নেই, তুমি তো আমারই মানুষ’! সেই দাবিটুকু থেকে অন্তত আমার এটুকু আবদার রেখো। তোমার হেঁটে চলার বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে অনেক অনেক-দিন সাথে হাঁটবার ইচ্ছেটা পূরণ নাহয় না হলো, অন্তত দুঃসময়ে কাজ আসতে পারলেও কিছুটা স্বান্তনা পাবো। আমার এ আবদারটুকু অন্তত ফিরিয়ো না, প্লিজ...

আর হ্যাঁ, নিজেকে অহেতুক সাজা দিয়ে লাভ নেই। আমরা প্রত্যেকেই তো সাজাপ্রাপ্ত আসামী। এই যে মানবজীবন নিয়ে বেঁচে থাকা, হৃদয়ের মৃত্যুর পরেও দেহের মৃত্যু না হওয়া খোলস নিয়ে বাঁচার অভিনয় করা, নিজের থেকেই নিজে পালিয়ে ফেরা - এসব নিশ্চয়ই কোনো দাগী আসামীর সাজার চেয়ে কম না। এরপরও কি আর সাজার দরকার আছে কোনো! নেই। সুতরাং বাঁচার অভিনয় চলুক। ভালো থেকো প্রিয়..... 


                                    
                                             —  ইতি
                        তোমার(!) বিদেশিনী কিংবা কাঙ্ক্ষিতা 

                                     ———


  ই-বুক অংশবিশেষ
~ ‘অর্ধেক জীবনের অর্ধেক ভ্রম(ণ)’ |২০২১
© সামি আল সাকিব


*পরীক্ষামূলক এই ‘ই-বুক’ টি যে কেউ আগ্রহী হলে বিনামূল্যেই পড়তে পারবেন। বইটির পিডিএফ লিংক 

 


 

Comments

Popular posts from this blog

বুক রিভিউ: যাপিত জীবন - সেলিনা হোসেন

বুক রিভিউ: মেমসাহেব - নিমাই ভট্টাচার্য

বুক রিভিউ : ‘বৃষ্টি ও মেঘমালা’—হুমায়ূন আহমেদ

প্রলাপা’য়োজন -০৪ | সামি আল সাকিব