বুক রিভিউ : অন্যদিন —হুমায়ূন আহমেদ


পাঠ-অনুভূতি : আমাদের জীবনটা একটা ট্রেনযাত্রার মতোন। যাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করি তাদের অনেকেই বিভিন্ন স্টেশনে নেমে যায়। এই যাত্রাপথের অল্প সময়েই অনেকের সাথে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। নতুন নতুন স্টেশন আসে, নতুন যাত্রী ওঠে, অনেকেই আবার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পেয়ে নেমে যায়। এভাবে একসময় আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্টেশন চলে আসে, আমরা নেমে পড়ি। অনেকেই সাথে নামে, অনেকেই থেকে যায়। জীবনটাও অনেকটা তেমনই, রেলগাড়িটার মতোন। চলতেই থাকে।

ঢাকার বেশ পুরানো আর জরাজীর্ণ খুপরীর মতোন এক বোর্ডিং বাড়ি। নাম পান্থনিবাস। পান্থনিবাসের সন্ধিঃচ্ছেদ করলে হয়, পথিকের বাস করার জায়গা। নামের সাথে একদম মিলে যাওয়ার মতোন একটা জায়গা পান্থনিবাস। হরেক কিসিমের কিছু লোক নিয়ে কোনোরকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এই বোর্ডিং। মালিক আর ম্যানেজার চেষ্টা করছেন বোর্ডিংটা বন্ধ করে নতুন কোনো হিল্লে করার। 

এই বোর্ডিংয়েরই বয়সে তরুণ এক বোর্ডার সফিক। তার বাল্যবন্ধু রঞ্জু। অবসরপ্রাপ্ত, কিছুটা পাগলা কিসিমের বাবার হেয়ালিপনা আর সংসারের টানাপোড়নে প্রায় স্তব্ধ হয়ে যাওয়া পরিবারের ঘানির হাল ধরার পাশাপাশি নিজের পড়ালেখাটাও পুনরায় চালু করবার জন্যই রঞ্জুর আগমন। বাল্যকালের সফিকের সাথে বর্তমানের এই সফিককে মেলাতে পারে না রঞ্জু। একদম সাদাসিধে  নিপাট ভদ্র ছেলে, ভালো শিক্ষার্থী সফিক যেন জীবনের যাঁতাকলে পিষে একদম পাল্টে গেছে। কিংবা হয়তো পাল্টাতে বাধ্য হয়েছে।

বোর্ডিং এ হরেক কিসিমের মানুষের সাথে পরিচয় হয় রঞ্জুর। বোর্ডিং এ প্রবেশ করেই তার পরিচয় ঘটে নিশানাথ নামের এক বয়সোর্ধ্ব জোর্তিষাণবের সাথে। সফিকের সাথে তার বেশ ভালো খাতির। সফিক লোকটাকে ভণ্ড বললেও তাকে ভালো মানুষ হিসেবেই মনে হয় রঞ্জুর।

একটা রেলগাড়ি যেমন হরেক ক্লাসের অনেকগুলো কামরা আর তাতে বিভিন্ন গন্তব্যের অনেক রকম যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে ছুটে চলে, তেমনি হরেক কিসিমের লোকের বাস, পান্থনিবাস নিয়ে এগোতে থাকে গল্প। সবারই ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্য, ভিন্ন ভিন্ন কামরা। মিল বলতে প্রত্যেকেই একই রেলগাড়ি তথা একই বোর্ডিংয়েরই বোর্ডার, এতোটুকুই। এখানে কেউবা সুখে তো কেউ বিষাদে, কারো পদোন্নতি অপেক্ষারত তো কারোর বা চাকরি চলে গেছে, মেস ভাড়া বাকি পড়ে গেছে বাকি। কেউবা স্ত্রীর প্রেমমাখা পত্র পায় তো কেউবা মায়ের অসুখ, বাবার পাগলামি, বোনের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে কিংবা অর্থের টানাপোড়নে ছোট ভাইবোনের পড়ালেখা বন্ধ হবার উপক্রম, সাংসারিক টানাপোড়নের খবর পায়।
কেউ কেউ প্রথম শ্রেণির কামরায় আয়েশে গন্তব্যে ছোটে তো কেউ কেউ তৃতীয় শ্রেণির কামরায় কোনোরকম দাঁড়াবার জায়গা খোঁজে। কারো কারো কাঙ্ক্ষিত স্টেশন এসে পড়েছে প্রায় তো কারো কারো গন্তব্য এখনো বহুদূর।
এভাবে রেলগাড়ির মতো করে বোর্ডিংয়ের বাসিন্দাদের জীবন এগোয়। একসময় অনেকে গন্তব্য পেয়ে নেমে পড়ে।যাত্রাপথের এই সময়টায় যে সঙ্গীর সাথে তার ভাব হয়, তাকে ছেড়েই নেমে যেতে হয় কাঙ্ক্ষিত স্টেশনে।

সঙ্গী? তার এখনো ম্যালা পথ বাকি। তাকে যেতে হবে আরো দূর, বহুদূর। জীবন কিংবা রেলগাড়ি যাইহোক, সবাই তো আর এক স্টেশনের যাত্রী হয়না। অনেককেই  সঙ্গীহারা নিঃসঙ্গ হয়ে এগিয়ে যেতে হয়, একেবারে নিঃসাড় হয়ে। গমগম করা রেলগাড়িতে অধিকাংশ যাত্রী নেমে যাবার পরেও কেউ কেউ গন্তব্যের জন্য ছোটে, এই ছুটে চলার বাকি পথ যেমন শূণ্যতা ভর করে রাখে, একাকীত্বের বিষাদ আগলে রাখে, তাকে সম্বল করেই এগোতে হয়। সঙ্গী থাক বা না থাকুক, এই যে এগিয়ে চলা, ছুটে চলা, এই ছুটে চলার নামই তো জীবন, মানবজীবন..


•              বই :  ‘ অন্যদিন ’
         লেখক :  হুমায়ূন আহমেদ 
         প্রকাশ :  ২০০৯সন
      প্রকাশক :  অন্বেষা প্রকাশন
 পাতা সংখ্যা :  ৬৪ টি
            ধরণ :  সমকালীন উপন্যাস

                                     ---


~ ০৪\০৩\২০২১

© সামি আল সাকিব


#পৃথিবী_বইয়ের_হোক📚



 

Comments

Popular posts from this blog

বুক রিভিউ: যাপিত জীবন - সেলিনা হোসেন

বুক রিভিউ: মেমসাহেব - নিমাই ভট্টাচার্য

বুক রিভিউ : ‘বৃষ্টি ও মেঘমালা’—হুমায়ূন আহমেদ

প্রলাপা’য়োজন -০৪ | সামি আল সাকিব